বিজিবি মোতায়েন, দুটি মামলায় আসামি ১ হাজার ।। নিহতদের পরিবারে কান্না কুতুবদিয়া থমথমে
মো. ছফওয়ানুল করিম ও ছোটন কান্তি নাথ ॥
পুলিশের সাথে জামায়াত-শিবিরের গোলাগুলিতে চারজন নিহত হওয়ার পর কুতুবদিয়ায় এখন থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। ঘটনার পর থেকেই গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মোতায়েন করা হয়েছে বিজিবি। এছাড়া র্যাব, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর বিপুল পরিমাণ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ও নাম নিয়ে বিভিন্ন বিভ্রান্তি দেখা গেলেও সরেজমিন পরিদর্শন শেষে ৩ ব্যক্তি নিহত হবার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়। নিহতরা হলো, দক্ষিণ ধুরুং মূসা সিকদার পাড়ার আবু বকরের পুত্র ইসমাঈল (১৬), লেমশিখালী কাজীর পাড়ার মোহাম্মদ আলমের ছেলে, লবণশ্রমিক আজিজুল হক প্রকাশ আয়েছ (১৪), উত্তর ধুরুং ফয়জানী পাড়ার মৃত ইসমাইল হোছাইনের ছেলে আব বকর প্রকাশ আবু (৫৫)। এ ঘটনায় পুলিশসহ আহত হয়েছে আরো অন্তত ৩০ জন। এদিকে জামায়াত নিহত ৩ ব্যক্তি তাদের কর্মী বলে দাবি করলেও নিহতের স্বজনদের দাবি তারা কোন রাজনৈতিক কর্মী নয়। নিহতদের নিজেদের কর্মী এবং হত্যার বিচার দাবিতে জামায়াত ইসলামী আজ কক্সবাজার জেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বান করেছে। স্থানীয়রা জানান, নিহতদের সবাই দরিদ্র শ্রমিক শ্রেণীর লোক। বাজারে সওদা করতে এসে জামায়াতের মিছিলের মাঝখানে পড়ে তারা পুলিশের গুলির মুখে পড়ে নিহত হয়। এদিকে মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলায় অন্তত ১ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। তন্মধ্যে ৯শ’ জনই অজ্ঞাত হওয়ায় কুতুবদিয়ায়বাসীর মাঝে এখন গ্রেপ্তার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। পুলিশ জানায়, তিনটি লাশের ময়নাতদন্ত শেষে বুধবার তাদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত জানা যায়, রাতেই জানাজা শেষে তিনজনের লাশ দাফনের প্রস্তুতি চলছে। এদিকে ঘটনার বিস্তারিত জানতে কুতুবদিয়া পরিদর্শন করেছেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. রুহুল আমিন ও জেলা পুলিশ সুপার (ভারপ্রাপ্ত) তোফায়েল আহমদ (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার)। বিকেলে জেলা প্রশাসক কুতুবদিয়া ত্যাগ করলেও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ঘটনাস্থলে রয়েছেন। কুতুবদিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জহিরুল ইসলাম গতরাত পৌনে আটটার দিকে দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘বর্তমানে এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। জানমালের নিরাপত্তায় পুরো উপজেলায় পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও আনসার সদস্য মোতায়েন রয়েছে। তবে গতকাল বুধবার রাত পর্যন্ত এ ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।’ ঘটনার বিষয়ে ওসি বলেন, জামায়াত-শিবিরকে সমাবেশ করতে বাধা দেয়ায় তারা উত্তেজিত হয়ে পুলিশের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় পুলিশ নিজের জীবন রক্ষার্থে গুলি চালাতে বাধ্য হয়।’ ওসি আরো বলেন, সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে ৪জন নিহত হওয়ার কথা প্রচার করা হলেও পুলিশ তিনটি লাশ উদ্ধার করতে পেরেছে। অপর একজনের লাশ কেন পাওয়া যাচ্ছে না বা কোথায় রয়েছে তার বিস্তারিত কিছুই বলতে পারেননি তিনি। কুতুবদিয়া থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক মো. আবুল কালাম জানান, মঙ্গলবার হরতাল শেষে সন্ধ্যার দিকে উত্তর ধুরুং বাজারে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই সমাবেশের ডাক দেয় জামায়াত-শিবির। অতীতের মতো নাশকতা সৃষ্টির বিষয়টি আঁচ করতে পেরে পুলিশ সমাবেশ থেকে বিরত থাকতে বলে কয়েকটি মাইক জব্দ করে। এরপর কোন ধরণের উষ্কানি ছাড়াই পুলিশের উপর হামলে পড়ে সশস্ত্র জামায়াত-শিবির কর্মীরা। এ সময় মসজিদের মাইক থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে উষ্কানি ছড়িয়ে জামায়াত-শিবির কর্মীদের সাথে সাধারণ মানুষ জড়ো করে পুলিশবাহী জিপটি ঘেরাও করে পুলিশ ও আনসারদের ব্যাপক মারধর করে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা । এ সময় থানা থেকে অতিরিক্ত পুলিশ তাদের উদ্ধার করতে গেলেও হামলার শিকার হয়। এরপর থেকে পুলিশ এ্যাকশনে যায় এবং জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র কর্মীদের সাথে সংঘর্ষ, গোলাগুলি, পাল্টা ধাওয়া, ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, ককটেল বিস্ফোরণ হয়। পুলিশ কর্মকর্তা আবুল কালাম আরো বলেন, হামলা ও সংঘর্ষের সময় পুলিশের দুটিসহ ৫টি যানবাহন ও অন্তত ২০টি দোকানে আগুন দিয়ে লুটপাট চালায় সশস্ত্র জামায়াত-শিবির কর্মীরা । ঘটনার বিবরণে স্থানীয় চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আল-আজাদ বলেন, ‘গতানুগতিকভাবেই পুলিশ জামায়াত শিবিরের মিছিলে হামলা করে গুলি চালালে নিরীহ লোকজন নিহত হয়।’ জামায়াতের উত্তর ধুরুং শাখার আমির সাবেক চেয়ারম্যান শাহরিয়ার চৌধুরী ও দক্ষিণ ধুরুং শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. আবু সাঈদ বলেন, ‘পুলিশ বিনা কারণে জামায়াত কর্মীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে পাখির মতো ৩ কর্মীকে হত্যা করে।’ ঘটনার বিবরণে ধুরুং বাজার ব্যবসায়ীদের অনেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘জামায়াত-শিবির মিছিল শেষে সমাবেশ করার জন্য চৌমুহনীতে মাইক লাগাতে গেলে পুলিশ মাইক জব্দ করে নেয়। এসময় পুলিশের সাথে জামায়াত কর্মীদের সাথে হাতাহাতি হয়। এক পর্যায়ে জামায়াত কর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট পাটকেল ছুঁড়লে পুলিশ স্থানীয় সজল নাথের দোকান ও শাহাব মিয়ার ভাতের হোটেলে আশ্রয় নেয়। জামায়াত কর্মীরা সেখানে গিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালালে পুলিশ গুলি চালায়। এতে ৩ ব্যক্তি ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায়।’ ঘটনাস্থলে থাকা কক্সবাজার সদর সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মুহাম্মদ খালেদ-উজ-জামান জানান, হতাহতের ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে কুতুবদিয়া থানায় ৫০ জনের নাম উল্লেখ ছাড়াও ৪৫০ জনকে অজ্ঞাত হিসেবে মোট ১ হাজার জনের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা রুজু করা হয়েছে। তন্মধ্যে একটি মামলা হয়েছে সন্ত্রাস দমন আইনে। জামায়াত ইসলামী চকরিয়া উপজেলার (দক্ষিণ) সেক্রেটারী জেনারেল মাওলানা মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক বলেন, ‘কুতুবদিয়ায় নির্বিচারে গুলি চালিয়ে দলের ৪জন নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে পুলিশ। উপর্যপুরি গুলিতে এখনো জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছে আরো অন্তত ১০জন। এদের মধ্যে মৌলভী মোহাম্মদ নোমান (৩৫), তাজুল ইসলাম (২৭) ও ফরহাদ (২২) এর অবস্থা আশঙ্কাজনক।’ এদিকে নিহত ইসমাইলের মা নুরুন্নাহার বেগম সাংবাদিকদের বলেন, ‘শহর থেকে বেড়াতে আসা তার অসুস্থ ছেলে সেদিন ওষুধ কিনতে বাজারে গিয়েছিল।’ সে চট্টগ্রামের একটি শিপ ইয়ার্ডে চাকরি করে বলে জানান তার মা। নিহত আজিজুল হক আয়েছের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুত্রকে হারিয়ে তার বাবা-মা বাকরুদ্ধ হয়ে আছেন। মাঝে মাঝে কেঁদে উঠেন, তারা কোন কথা বলতে পারছেন না। এলাকার লোকজন জানান, আয়েছ একজন লবণ শ্রমিক। সে মজুরির টাকা নিতে সেদিন বাজারে গিয়েছিলেন। আর ফিরলেন লাশ হয়ে। নিহত আবু আহম্মেদ প্রকাশ আবু পেশায় দিনমজুর। আবুর স্ত্রীর দাবি তার স্বামী রাজনীতি কি জিনিস তা-ই জানতেন না। তিনি বলেন, ‘তাকে নিয়ে কেউ টানাহেঁচড়া করুক তা আমি চাই না।’ বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি জামায়াতের : মহেশখালী-কুতুবদিয়া আসনের সংসদ সদস্য হামিদুর রহমান আযাদ এক বিবৃতিতে কুতুবদিয়ায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছেন। একইভাবে ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং বৃহস্পতিবার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল সফল করার লক্ষ্যে সর্বস্তরের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহবান জানিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম জোনাল নেতৃবৃন্দ এক যুক্ত বিবৃতি প্রদান করেন। বিবৃতিদাতা জোনাল জামায়াত নেতৃবৃন্দ হলেন জামায়াতে ইসলামীর চট্টগ্রাম মহানগরী আমীর মাওলানা আ.ন.ম শামসুল ইসলাম এমপি ও মাওলানা মুমিনুল হক চৌধুরী, কক্সবাজার জেলা জামায়াতের আমীর মুহাম্মদ শাহজাহান, সেক্রেটারি জি.এম রহিম উল্লাহ প্রমুখ। চকরিয়া উন্নয়ন ফোরাম চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান চৌধুরী মানিকও পৃথক বিবৃতিতে একই দাবি জানান।